Thursday, August 22, 2013

বয়াতির বয়াতি আব্দুর রহমানের দেহ ঘড়ির সময় ফুরিয়ে গেল

প্রায় চার যুগ ধরে তিনি বাউল গান শুনিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের মানুষকে মাতিয়ে রেখেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা লোকগানকে করেছেন সমৃদ্ধ। হ্যাঁ, তিনি আব্দুর রহমান বয়াতির। জন্ম ১৯৩৬ সালে ১ জানুয়ারি ঢাকার দয়াগঞ্জে। আব্দুর রহমান বয়াতির বাবার নাম তোতা মিয়া। দয়াগঞ্জ বাজারে তোতা মিয়ার একটি হোটেল ছিল। সেখানে মাঝে মধ্যে অনেক গুণী বাউল শিল্পীর আসর বসত। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে আব্দুর রহমানের ভেতর গানের প্রতি ভালবাসার সূত্রপাত।
ছোটবেলা থেকেই বাউল গানের প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আকর্ষণ। যেখানে বাউল গানের আসর বসত সেখানেই ছুটে গিয়ে সামনের সারিতে বসে মনেপ্রাণে গান শুনতেন। প্রখ্যাত বাউল শিল্পী আলাউদ্দিন বয়াতী, মারফত আলী বয়াতী, খালেক দেওয়ান, হালিম বয়াতী, রজ্জব আলী দেওয়ান, আলেক দেওয়ান , দলিল উদ্দিন বয়াতীসহ বহু শিল্পী প্রায়ই আসতেন গানের অনুষ্ঠান করতে। বাবার অনুপস্থিতিতে মনভরে বাংলার বাউল গান শুনতেন এবং নিজেও রপ্ত করে ফেলতেন। গানে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও, আব্দুর রহমানের একটি অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, একটি গান একবার শুনলে পরক্ষণে হুবহু গাইতে পারতেন তিনি। একা একা বসে চেয়ার-টেবিল অথবা মাটির পাতিলকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়ে গুনগুনিয়ে গান করতেন।
এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে গান গাইতে বললে গানপাগল কিশোর আব্দুর রহমান গেয়ে উঠলেন ‘লাউয়ের আগা খাইলাম ডগা খাইলাম এনই সাধের ডুগডুগি, আমার কদুর বয়সে করলো বৈরাগী।’ তাঁর কণ্ঠের সুরের কারুকাজ শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিল্পী আলাউদ্দিন বয়াতী সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বুকে টেনে নেন। সেই থেকে শুরু হলো তাঁর নতুন জীবন। মনে মনে গ্রহণ করেন এই কালজয়ী বাউল শিল্পীর শিষ্যত্ব্ব। কিন্তু আব্দুর রহমানের সঙ্গীত জগতে প্রবেশ পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর বাবা। ছেলের গান গাওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারলেন না। এমন সময় তাঁর পাশে ভাগ্যদেবী হয়ে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলেন মা আজমেরী বেগম। বাবার সাফ জানিয়ে দেন, ছেলে গান গাইলে ঘরের দরজা তাঁর জন্য চিরতরে বন্ধ।
বাবার নিষেধ অমান্য করেও রহমান ছুটে যেতেন বয়াতীদের গানের আসরে। কখনো কখনো বাবার বকুনি খেয়ে গানের জন্য ঘর থেকে পালালেও মমতাময়ী মা রাতের আঁধারে চুরি করে ভাতের থালা তুলে দিতেন আব্দুর রহমানের হাতে। মায়ের মনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল, তাঁর ছেলে একদিন বড় সঙ্গীতশিল্পী হবে। এজন্যই তিনি মমতা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। সেই সময় প্রতি বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট মাজারে কাওয়ালি গানের আসর বসত। ১৫ মিনিট সময় দেয়া হত বাউল গানের জন্য। আব্দুর রহমান যথারীতি চলে যেতেন এবং গান শুনিয়ে মতিয়ে রাখতেন আসর। একদিন হাইকোর্ট মাজারে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক শাহনেওয়াজ বিটিভিতে অডিশনের জন্য নিয়ে যান আব্দুর রহমানকে। কিন্তু ঢাকার লোক ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, এই অযুহাত দেখিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। পর পর দুইবার সত্য বলায় সে অডিশন থেকে একই অযুহাতে বাদ পড়ায়, তৃতীয়বার মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। তৃতীয়বার তাঁকে অডিশনের জন্য ডাকেন বরেণ্য শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বাড়ি কোথায় ? তিনি বলেছিলেন, বাবার পৈতৃক বাড়ি বিক্রমপুরে। মিথ্যা বললেও এ ছিল এক চরম সত্য। এরপর আব্দুর রহমানের জীবনে আসে এক নতুন বসন্ত। ১৯৭২ সালে দেশের বরেণ্য শিল্পী আব্দুল আলীমের সঙ্গে নিজের লেখা ও সুর করা ‘মরণেরই কথা কেন স্মরণ কর না, আজরাইল আসিলে কারো কৈফিয়ত চলবে না’ গানটি বিটিভিতে পরিবেশন করে শ্রোতাদের কাছে অনেক প্রিয় হয়ে ওঠেন।
ষাটের দশকে বাংলাদেশ বেতারে গান গেয়ে জয় করে নিয়েছেন অগণিত শ্রোতার মন। এর পর দীর্ঘ সময় আলাউদ্দিনের সঙ্গে আব্দুর রহমানের দেখা না হলেও তাঁর অনেক গান তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। অনেক দিন পর রথখোলার মোড়ে খালেক দেওয়ানের সঙ্গে পালা গানে অংশ নেন আব্দুর রহমান। সেই সময় আলাউদ্দিন বয়াতীকে একটি লোক এসে বলেন, খালেক দেওয়ানের সাথে পালা গান গাইবেন আপনার এক শিষ্য, নাম রহমান। তিনি চিন্তায় পড়ে যান। এ নামে তাঁর কোন ছাত্র আছে কিনা মনে করতে পারছিলেন না। ছুটে যান গানের আসরে। ভোর পর্যন্ত চলছিল পালা গান। রহমান পালা শেষে শুনতে পান চাদর মুড়ি দিয়ে আলাউদ্দিন বয়াতী তাঁর গান শুনছে। রহমানের গলায় ছিল একটি টাকার মালা। তিনি এটি নিয়ে আলাউদ্দিন বয়াতীর গলায় পরিয়ে দেন। তখন তাঁকে সবাই চিনতেন আব্দুর রহমান নামে, সেই দিন আলাউদ্দিন বয়াতী বলেন, তুমি যখন আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছো, আজ থেকে তোমার নামের শেষেও থাকবে বয়াতী। তার পর থেকে আব্দুর রহমানের নাম হলো, আব্দুর রহমান বয়াতি।
অর্থের অভাবে লেখাপড়ায় বেশি অগ্রসর হতে পারেননি আব্দুর রহমান। মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। আক্ষরিকভাবে যথাযথ শিক্ষা লাভ না করলেও আব্দুর রহমান বয়াতী দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে একজন গুণী শিল্পীকে সম্মান দেখাতে হয়। তিনি শুনে শুনে হাজার হাজার গান রপ্ত করা ছাড়াও পালা গানের বিভিন্ন কৌশল, কোরান, হাদিস, গীতা, বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বজ্ঞান আয়ত্ব্ব করেন। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় কয়েকটি গান হল- ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মেস্তরি বানাইছে’, ‘আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে’, মরণেরই কথা কেন স্মরণ কর না’, ‘মা আমেনার কোলে ফুটলো ফুল’, ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাবো নদীয়া’, ‘আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণের ধৈর্য মানে না’ সহ অসংখ্য গান।
তাঁর বেশ কিছু অডিও ক্যাসেট, ভিডিও সিডি ও রিমিক এ্যালবাম আছে, যেগুলো এখনও শ্রোতাদের কাছে অনেক প্রিয়। চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজের আমন্ত্রণে বাউলশিল্পী হিসেবে তিনি জীবনে প্রথম ‘গুণাহগার’ নামে একটি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। এ ছাড়া মোস্তাফিজুর রহমানের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। তিনি জমিউর রহমান লেমনের ‘পরানের গহীনে’ নামে একটি নাটকে অভিনয়ও করেছেন। খান আতাউর রহমানের ‘ফারাক্কা’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে অংশ নিয়েছিলেন। গানের পাশাপাশি তিনি কিছু ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আমজাদ হোসেনের ‘কসাই’, মফিজ উদ্দিনের ‘অসতী’ এবং সাহাদাত খানের ‘হৃদয় থেকে হৃদয়।’ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সেগুলো হলো ‘হাঁস-মুরগির খামার’, ‘নিরক্ষরতা’, ‘শিশুশিক্ষা’, ‘পঞ্চম জাতীয় পলিও টিকা দিবস’, ‘বনের শোভা পশুপাখি তাদেরকে কেউ মাইরো না’, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘নির্বাচনী প্রচারণা’, ‘৮৮ বন্যা’, ‘খরার সময়ে বৃষ্টির জন্য বিজ্ঞাপন’, ‘ক্রীড়া উন্নয়ন লটারী’ ও ‘পরিবার পরিকল্পনা।’
১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৫ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১০ মিনিটের একটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের পরই এই শিল্পীর খ্যাতি সারাবিশ্বে ছড়াতে থাকে। পৃথিবীর প্রায় ৩২টি দেশে তিনি লোকসঙ্গীতের মরমী সুর ছড়িয়ে দেন। বিদেশের মাটিতে তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে ডিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।
তিনি যে সব পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তা-ই তাঁর জীবন সর্বস্ব। এগুলো হলো-সিটিসেল চ্যানেল আই এ্যাওয়ার্ড, সোলস এ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক ফোরাম কর্তৃক লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে গুণীজন সংবর্ধনা, নজরুল একাডেমী সম্মাননা ২০০৪, সমর দাস স্মৃতি সংসদ এ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ বাউল সমিতি আজীবন সম্মাননা এ্যাওয়ার্ড, মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতি আজীবন সম্মাননা এ্যাওয়ার্ড, ইউএসএ জাগরনী শিল্পীগোষ্ঠী এ্যাওয়ার্ড, স্বরবীথি থিয়েটার বাংলা নববর্ষ ১৪১২ উপলক্ষে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান, কায়কোবাদ সংসদ আজীবন সম্মাননা, স্পেল বাউন্ড বিশেষ সম্মাননা, বাংলাদেশ বাউল সংগঠন থেকে গুণীজন সম্মাননা পদক, বিক্রমপুর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থা থেকে সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি স্বর্ণ পদক ও আজীবন সম্মাননা-২০০৫, সিটি কালচারাল সেন্টার থেকে গুণীজন সম্মাননা পদক, বাউল একাডেমী পদক, একতা এ্যাওয়ার্ড, লোকসঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য স্বীকৃতি স্বরূপ লোকজ বাউলমেলা পদক ২০০৪, ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমী সম্মাননা পদক ২০০৬ ও শ্রেষ্ঠ বাউলশিল্পী অডিও ক্যাসেট পুরস্কার।
বাউল গানের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আব্দুর রহমান বয়াতী আজ আর নেই। আজ ১৯ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই শিল্পী।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। এই বাউল শিল্পীর অসামান্য অবদান বাঙালী জাতী ভুলতে পারবে না কোন দিন।
 — withMoktel Hossain Mukthi and 10 others.