অস্ত্র আসার বিষয়টি আগে থেকে জানতেন মোহসীন`
দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান আসার বিষয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিইউএফএল’র তৎকালীন এমডি মোহসীন উদ্দিন তালুকদার আগে থেকেই অবগত ছিলেন বলে জানিয়েছেন এ মামলার অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.মনিরুজ্জামান চৌধুরী। মোহসীন উদ্দিন তালুকদারের জ্ঞাতসারেই সিইউএফএল জেটিতে অস্ত্রগুলো খালাস হয়েছে বলেও দাবি করেছেন আলোচিত এ তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমানের আদালতে আসামী মোহসীন উদ্দিন তালুকদারের আইনজীবী এডভোকেট ফজলুর রহমান ভূঁইয়ার জেরার সময় এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান এসব কথা বলেন। তবে আইনজীবী দ্রুত প্রশ্ন পরিবর্তন করায় আদালত বিষয়টি রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
জেরার এক পর্যায়ে মনিরুজ্জামানের কাছে আইনজীবী মোহসীন উদ্দিন তালুকদারকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি জানতে চান।
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ তাকে অস্ত্র মামলায় তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। এরপর অপর মামলায় পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।’
আইনজীবী বলেন, আপনি মোহসীন উদ্দিন তালুকদারকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে তিনদিন পর আদালতে প্রেরণ করেছেন। জবাবে বিষয়টি সত্য নয় বলে জানান মনিরুজ্জামান।
এরপর আইনজীবীর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান জানান, তিনি সাবেক শিল্প সচিব ড.শোয়েব আহমেদ, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম এবং পুলিশ কমিশনার এস এম সাব্বির আলীকেও বিভিন্ন সময় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
মনিরুজ্জামান জানান, ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই ইমামুজ্জামানের জবানবন্দির ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তার লিখিত বিবৃতিতে তার স্বাক্ষর নেয়া হয়।
এসময় আইনজীবী মত দেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের টাইপ করা বিবৃতিতে ইমামুজ্জামানকে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছিলেন। জবাবে বিষয়টি সত্য নয় বলে জানান মনিরুজ্জামান।
এরপর আবারও আইনজীবী মত দেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহসীন উদ্দিন তালুকদারকে ফাঁসানোর জন্য মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামানকে শেখানোমত বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিলেন। জবাবে বিষয়টি সত্য নয় বলে উল্লেখ করেন মনিরুজ্জামান।
এসময় মনিরুজ্জামান আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্র আসার বিষয়টি মোহসীন উদ্দিন তালুকদার আগে থেকেই অবগত ছিলেন। তার জ্ঞাতসারেই সিইউএফএল জেটি দিয়ে অস্ত্র খালাস হয়েছে।’
তবে আইনজীবী এসময় দ্রুত প্রশ্ন পরিবর্তন করে ফেলেন। এর ফলে আদালত মনিরুজ্জামানের শেষ জবাবটি রেকর্ড করেননি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
এসময় আইনজীবী দ্রুত প্রশ্ন পরিবর্তন করে বলেন, সাক্ষী এস এম সাব্বির আলীর কাছ থেকেও টাইপ করা বিবৃতি আদায় করে পরে হুবহু রেকর্ড করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। জবাবে বিষয়টি সত্য নয় বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এসময় মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের বিবৃতি আমার একাধিক ক্লার্ক দ্বারা লিখিয়েছি। তবে বিবৃতিতে আমার দ্বারা রেকর্ডকৃত কথাটি লেখা আছে।’
এরপর বিকেল ৫টায় আসামী মোহসীন উদ্দিন তালুকদারের আইনজীবী এডভোকেট ফজলুর রহমান ভূঁইয়ার জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় আদালত এ মামলার কার্যক্রম বুধবার পর্যন্ত মূলতবি করেন।
মঙ্গলবার সাক্ষ্যগ্রহণের সময় সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ এ মামলায় কারাগারে থাকা ১১ আসামীকে আদালতে হাজির করা হয়।
উল্লেখ্য ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইনে ও চোরাচালানের অভিযোগে দু’টি মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ প্রায় অর্ধশত লোককে আসামী করা হয়।
মামলা দু’টির সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপরে তৎকালীন কৌসুলী মহানগর পিপি আহসানুল হক হেনার আবেদনের প্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন আদালত।
প্রায় সাড়ে তিন বছর অধিকতর তদন্তের পর ২০১১ সালের ২৬ জুন নতুনভাবে আরও ১১ আসামীর নাম অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৎকালীন এএসপি মো.মনিরুজ্জামান।
এরপর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিচার।
সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর থেকে এ মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক শিল্পসচিব ড. শোয়েব আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএইফআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, ডিজিএফআই’র সাবেক ডিটাচমেন্ট কমান্ডার কর্নেল (অব) একেএম রেজাউর রহমান, এনএসআই’র সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী এবং সাবেক সিএমপি কমিশনার এস এম সাব্বির আলী, সিএমপি’র বন্দর জোনের তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল্লাহ হেল বাকী, সাবেক ডিআইজি (এসবি) শামসুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহমেদ, সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদুর রহমান, সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন, সার্জেন্ট আলাউদ্দিন, গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমান, ম্যানেজার তসলিম মল্লিক, ট্রাক ভাড়া করার মধ্যস্থতাকারী শেখ আহমদ, হাবিলদার গোলাম রসুল, কর্ণফুলী থানার সাবেক ওসি আহাদুর রহমান এবং সিইউএফএলদর সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মবিন হোসেন খান, বিচারক ওসমান গণি, মো.মাহাবুবুর রহমান, আবু হান্নান ও মুনতাসির আহমেদ, সাবেক মহানগর হাকিম কিরণ চন্দ্র রায়, সিইউএফএল’র উপ ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) গোলাম মোস্তফা, বন্দর ফাঁড়ির সাবেক কনস্টেবল কে এম মহিউদ্দিন, সিইউএফএল’র সাবেক এমডি আব্দুস সালাম খান, সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ তাইয়েবুর রহমানসহ ২৯ জন ইতোমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার পঞ্চম তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান এ মামলার ৩০ তম সাক্ষী।
No comments:
Post a Comment